অনুসন্ধানী রিপোর্ট কি? অনুসন্ধানী রিপোর্টের বৈশিষ্ট্য এবং লেখার ধাপসমূহ লিখ।
অনুসন্ধানী রিপোর্ট কি?
একটি প্রতিবেদনে সাধারণত আমরা 5W-1H (কে, কি, কোথায়,কখন, কেন, কীভাবে) এর উত্তর খুজেঁ থাকি। যা কিনা কিছু প্রশ্নে উত্তর, কিন্তু অনুসন্ধানি সাংবাদিকতায় খুঁজতে হয় উত্তরের পাশাপাশি তথ্যের দলিল বা প্রমাণ। সাধারণ প্রতিবেদন যেখানে শেষ হয়, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সেখান থেকেই শুরু। এখানে প্রতিবেদকের নিজস্ব মতামত, ব্যাখ্যা, ভাবাবেগের কোন স্থান নেই। ‘শার্লক হোমস’ যেমন এক একটি লুকানো ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতেন, ঠিক তেমনি একজন সাংবাদিক তার নিজের কৌশল, অভিজ্ঞতা এবং শ্রম দিয়ে লুকানো সঠিক তথ্যটি জনসম্মুখে বের করে আনেন। এই কাজের জন্য একজন সাংবাদিককে সাধারণত প্রকাশ্য ও গোপন নানা উৎস (সোর্স) ব্যবহার করতে হয়, ঘাটতে হয় নানা ধরনের নথিপত্র।
William L. Rivers এবং Paul Williams তাদের Investigative Reporting গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
“Investigation reporting is a process of opening closed
doors and closed mouths”
অনুসন্ধান শব্দের আভিধানিক অর্থই হলো প্রণালিবদ্ধ বা নিয়মানুগ (সিস্টেম্যাটিক) তদন্ত বা অন্বেষণ। অনুসন্ধানের মাধ্যমে উদঘাটিত তথ্য নিয়ে যে প্রতিবেদন তাই অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে কখনো কখনো এন্টারপ্রাইজ, ইন-ডেপথ বা প্রজেক্ট রিপোর্টিংও বলা হয়ে থাকে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য হলো সতর্কতার সঙ্গে অনুসন্ধানের কৌশল নির্বাচন, তথ্যের জন্য প্রাথমিক সোর্সের ওপর নির্ভর করা, একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তাকে পরখ করে দেখা এবং সবশেষে নিখুঁতভাবে সত্যতা যাচাই করা।
অনুসন্ধানি সাংবাদিকতার ইতিহাস দেখলে বুঝা যায় বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তার সোনালী অতীতের কথা। যেমন: ১৯৫৮ সালে ওয়ালষ্ট্রিট জার্নালের পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী রিপোর্টার এড কনি কিউবার রাজধানী হাভানা থেকে রিপোর্ট পাঠালে তাতে তাদের অর্থনীতির আয়নায় ধরা পড়লো সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এতে বিশ্বের সামনে ফুটে উঠেছিল কিউবার ভবিষ্যৎ। এছাড়াও অনেক অনেক ঘটনা রয়েছে যে, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার ফলে অনেক কালো আইন বাতিল হয়েছে, নতুন আইন সৃষ্টি হয়েছে। অন্যায়, অত্যাচার, ঘুষ, কেলেঙ্কারী, অসদুপায় অবলম্বনের ঘটনাকে তুলে ধরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদকেরা বিশ্বের রথি- মহারথির পতন ত্বরান্বিত করেছেন। এদের মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী তানাকা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী উল্লেখযোগ্য।
বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হচ্ছে ‘ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল’। ১৯৭৪ সালে আমেরিকান ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশন চলাকালে রিপাবলিকান পার্টির কয়েকজন সদস্য কনভেনশন হলে ইলেকট্রিক আড়ি পাতার যন্ত্র (Bugging Device) স্থাপন করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। প্রাথমিক প্রতিবেদনে সিঁধেল চুরির ঘটনা থেকে উঠে আসে বিশ্বকাঁপানো ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারী। যার ফলে আমেরিকাতে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হয়। এতে নিক্সন প্রশাসনের অনেকে জেলে যান এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করেন। Bob
Woodward ও Carl
Bernstein তাদের All the
President’s Men গ্রন্থে পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত ঘটনা বিবৃত করেছেন।
– সাংবাদিকতায় সাক্ষাতকার নেয়ার কৌশল
সত্যের পথে থেকে নিঃস্বার্থভাবে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করলে যেমন মিলবে পরিচিতি, সম্মান, পুরস্কার তেমনি মিথ্যা তথ্যকে সত্য বলে প্রমাণ করতে চাইলে মিলবে তিরস্কার। সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরা All the Prime minister’s men শিরোনামে শেখ হাসিনা ও সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের নামে পুরোনো কিছু মিথ্যাচারের কাহিনী রচনা করেছে। এর আগেও ডেভিট বার্গম্যানের নেতৃত্বে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীর বিচার থামিয়ে দেওয়া সহ, ৫ মে শাপলাচত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের কোনো সংবাদ না দিলেও বার্গম্যানের সহায়তায় গুজব ছড়িয়েছিল শত শত মৃত্যুর কথা। অথচ সেদিন কোনো হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি আজও।
এটি একটি জনস্বার্থবিষয়ক রিপোর্টিং, যা সত্য ঘটনা তুলে ধরে। এ ধরনের প্রতিবেদনকে সুনিদিষ্ট সিধান্ত বা তথ্য দেয়া থাকে। এটা আন্দাজ বা অনুমানভিত্তিক নয়। যে কোন পত্রিকার জন্য তদন্ত ভিত্তিক প্রতিবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটি একটি পত্রিকাকে দ্রুত জনপ্রিয় করে তুলতে পারে। এ ধরনের প্রতিবেদন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের প্রতি পাঠক সমাজের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কিন্তু ভুল তথ্য পরিবেশন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে ।
অনুসন্ধানী রিপোর্টের বৈশিষ্ট্য
অনুসন্ধানী রিপোর্টিং অন্যান্য সাধারণ রিপোর্টিং থেকে কিছুটা আলাদা । নিচে অনুসন্ধানী রিপোর্টিং এর বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করা হলো ।
১. জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট
২. ফলাফল ধর্মী
৩. গবেষণা ধর্মী
৪ . তথ্য উন্মোচন
৫ . সময় সাপেক্ষ
৬. ব্যয়বহুল
৭. তথ্যনির্ভর
অনুসন্ধানী রিপোর্টের বৈশিষ্ট্য
১. জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট
জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে হয় । জনগণকে যেসব তথ্য প্রভাবিত করে সে সব তথ্য নিয়ে এখানে কাজ করা হয় । সরকারের অর্থ কেলেঙ্কারি কিংবা বিদ্রোহী কোন গ্রুপের সাথে গোপণ আঁতাত এসব বিষয় এধরনের রিপোর্টিং এর বিষয় হতে পারে । এ ধরনের রিপোর্টিং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষ স্থানে অবস্থানকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অপকর্ম , দুর্নীতি কিংবা ভুল ভ্রান্তি প্রকাশ পায় ।সাধারণ মানুষ সচেতন হতে পারে এধরনের রিপোর্টিং এর মাধ্যমে ।
২. ফলাফল ধর্মী
অনুসন্ধানী রিপোর্ট কে ফলাফল ধর্মী হতে হবে । ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয় । বোফর্স কেলেঙ্কারির জন্য পতন হয়েছিল রাজীব গান্ধীর সরকারের ।
৩. গবেষণা ধর্মী
অনুসন্ধানী রিপোর্ট এ তথ্যের সত্যতা নিরূপণের জন্য প্রচুর গবেষণা করতে হয় বা গবেষণার মাধ্যমে অজানা তথ্য বের কর আনা হয় । আর এজন্য টিম ওয়ার্কিং এর ভিত্তিতে অনুসন্ধানী রিপোর্টারকে কাজ করতে হয় ।
৪ . তথ্য উন্মোচন
অনুসন্ধানী রিপোর্টিং হচ্ছে এক ধরনের তথ্য উন্মোচনের প্রক্রিয়া । ইচ্ছাকৃত ভাবে গোপন করা তথ্য বা বা এড়িয়ে যাওয়া তথ্য এখানে বের করে আনার চেষ্ঠা করা হয় ।
৫ . সময় সাপেক্ষ
অনুসন্ধানে রিপোটিং অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ । ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির তথ্য বের করতে দুই বছর সময় লেগেছিল । আমাদের দেশের পত্রিকাগুলো সাংবাদিকদের এত দীর্ঘ সময় দেয় না বলেই পত্রিকাতে চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী রিপোর্ট তেমন একটা দেখা যায়না ।
৬. ব্যয়বহুল
অনুসন্ধানী রিপোর্টিং ব্যয়বহুল । সংবাদ সূত্রকে টাকা দিতে হয় নানা জায়গায় । নানা জায়গায় যেতে হয় , বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করতে হয় । এজন্য অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয় ।
৭. তথ্যনির্ভর
অন্য রিপোর্ট এর মত অনুসন্ধানী রিপোর্টও তথ্য ছাড়া মূল্যহীন । এখানে মূলত অজ্ঞাত তথ্য জ্ঞাত করতে হয় । রিপোর্টার তথ্য দিয়েই জনস্বার্থ বা রাষ্ট্র স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় প্রমাণ করবেন ।
অনুসন্ধানী রিপোর্ট লেখার ধাপসমূহ
১ . একটি ধারণা ,সামান্য একটু তথ্য কনা থেকেই অনুসন্ধানে রিপোর্টিং এর যাত্রা শুরু হয় । এ ধারণা গোপণ সূত্র বা কাগজপত্র ঘাটাঘাটি বা দৈনন্দিন কাজের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসতে পারে ।
২. একটি বিষয়কে নিয়ে শক্তিশালী ধারণা গড়ে ওঠার পর তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা , বিষয়টি তদন্ত করার মত কিনা , রহস্যের উদ্ঘাটন কতটুকু জনস্বার্থ সম্বলিত হবে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা ।
৩. সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নিবেন রিপোর্টার সামনে এগোবেন কিনা । যদি সামনে এগোনোর সিদ্ধান্ত নেন তবে এখানে তাকে তার সর্বোচ্চ লক্ষ্যটি ঠিক করে নিতে হবে । অর্থাৎ , বিষয়টি নিয়ে তিনি কি করবেন তা স্থির করতে হবে ।
৪. এধাপে রিপোর্টারকে তার কাজের পরিকল্পনা ও ভিত্তি নির্মাণ করতে হবে । তদন্ত করতে গিয়ে কোন কোন কৌশল অবলম্বন করবেন, কোন কোন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করবেন তার সিডিওল ঠিক করতে হবে ।
৫. এ ধাপে রিপোর্টিং সম্পর্কে প্রাথমিক গবেষণা করতে হবে । এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় অত্যাবশ্যক । সেগুলি হল – সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে বই পড়া ,বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া , প্রত্যক্ষদর্শী বা অভিজ্ঞতা অর্জন কারীদের সাথে কথা বলা
৬. এ পর্যায়ে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের চূড়ান্ত মূল্যায়ন করতে হবে । এখানে রিপোর্টার দেখবেন যা কিছু তথ্য তিনি পেয়েছেন তা থেকে অভিযোগ উত্থাপন করলে তা টিকে কিনা ।
৭. সম্পাদকের সাথে কথা বলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের রিপোর্টের একটি খসড়া কপি তৈরি করা এবং তা সম্পাদককে দেখানো ।
৮. সব শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করার কাজে নেমে পড়া
No comments