১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ উল্লেখ কর।

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ উল্লেখ কর।
Mention the reason of wining the provineial election of 1954 by the united fornt.

১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট বিশাল ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিল ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট জিতেছিল ২২৩টিতে এর মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ৪৮, নেজামে ইসলাম পার্টি ১৯ এবং গণতন্ত্রী দল ১৩টি আসন পেয়েছিল অমুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ৭২টি আসনের মধ্যে গণতন্ত্রী দল তিনটি এবং কমিউনিস্ট পার্টি চারটি আসন পাওয়ায় যুক্তফ্রন্টের সর্বমোট সদস্য সংখ্যা হয়েছিল ২৩০ অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পেয়েছিল মাত্র ১০টি আসন বিজয়ের পর ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত যৌথ সভায়শেরে বাংলাআবুল কাশেম ফজলুল হককে যুক্তফ্রন্টের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়েছিল পরদিন এপ্রিল ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধান বা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন কোন দল থেকে কতজনকে মন্ত্রী করা হবে- সে প্রশ্নে মতপার্থক্য সৃষ্টি হওয়ায় আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রথমে মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়া থেকে বিরত থেকেছে ফলে এপ্রিল ফজলুল হক মাত্র তিনজনকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করেন তারা ছিলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবু হোসেন সরকার সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া এবং নেজামে ইসলাম পার্টির আশরাফউদ্দিন চৌধুরী
আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মন্ত্রী নেয়া হয়েছিল ১৫ মে মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, হাশিমউদ্দিন আহমদ এবং শেখ মুজিবুর রহমান কেএসপির নেতা হলেও কফিলউদ্দিন চৌধুরীকেও আওয়ামী মুসলিম লীগের কোটা থেকে মন্ত্রী করা হয়েছিল সব মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ছাড়া মোট ১২ জনকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা এই মন্ত্রিসভা অবশ্য বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি আদমজীতে সংঘটিত দাঙ্গা এবং পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা হবে বলে কলকাতায়শেরে বাংলা কথিত ঘোষণা প্রভৃতির অজুহাতে ২৯ মে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বাতিল করা হয় একই সাথে পূর্ব বাংলায় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ১২- ধারা জারি করে গবর্নরের শাসন প্রবর্তন করা হয়েছিল গবর্নর পদে নিযুক্তি দেয়া হয় মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে এর মধ্য দিয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সে রাজনীতিরই বাস্তবায়ন ঘটেছিল, যার কারণে প্রতিষ্ঠাকালেই পাকিস্তান থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছিল
প্রসঙ্গক্রমে এখানে কয়েকটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার :
 . পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পর ১৯৪৯ সালে অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইলের একটি আসনের উপনির্বাচনে প্রথমে মওলানা ভাসানীর কাছে এবং পরে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের কাছে করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নী পরাজিত হয়েছিলেন জমিদার পন্নী ছিলেন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রার্থী এই পরাজয়ের কারণে সরকার ১৯৫৪ সালের আগে পূর্ব বাংলা প্রদেশে আর কোনো নির্বাচনের আয়োজন করেনি ফলে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট নির্বাচিত পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ব বাংলা সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্বহীন অবস্থায় ছিল কারণ, ৭৯ সদস্যের গণপরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধির সংখ্যা ৪৪ জন থাকলেও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মতো মোহাজের ব্যক্তিরা প্রতিনিধিত্ব করে আসছিলেনÑ যারা পূর্ব বাংলা বা বাঙালির পক্ষে কোনো ভূমিকা রাখেননি
. যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জন্য সম্ভাবনার সৃষ্টি হলেও বানোয়াট অভিযোগে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভাকে বাতিল করার পাশাপাশি ৯২- ধারার আড়ালে বিশেষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতাকে গ্রেফতার করেছিল সরকার দলের সভাপতি মওলানা ভাসানীকে প্রকাশ্যে গুলী করে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন গবর্নর ইস্কান্দার মির্জা সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেয়ার কারণে মওলানা ভাসানী সে সময় দেশে ছিলেন না তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে করাচীকেন্দ্রিক ক্ষমতাসীন চক্র ষড়যন্ত্রকারীরা সাফল্যের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টে ভাঙন সৃষ্টি করেছিল ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তফ্রন্টের সংসদীয় দলের সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানশেরে বাংলাফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং তার ফলে যুক্তফ্রন্টে ভাঙন ঘটে উল্লেখ্য, কলকাতা থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী যুক্তফ্রন্টের ঐক্য টিকিয়ে রাখার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন কিন্তু শেখ মুজিব অনমনীয় থাকায় যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গিয়েছিল
. যুক্তফ্রন্টের এই ভাঙনে দলগতভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগ এর কারণ, ৯২- ধারা প্রত্যাহারের পর ১৯৫৫ সালের জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় গঠিত মন্ত্রিসভাযুক্তফ্রন্টনাম নিয়েই শপথ নিয়েছিল অর্থাৎ যুক্তফ্রন্ট সরকারই ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল কিন্তু যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক আওয়ামী মুসলিম লীগ এতে সুযোগ পায়নি এরই পাশাপাশি দলত্যাগ করেছিলেন আওয়ামী লীগের ৩৯ জন সদস্য, যার ফলে দলটির পরিষদ সদস্য সংখ্যা কমে হয়েছিল ১০৪ ওদিকে গণপরিষদের ৩১টি মুসলিম আসনের নির্বাচনেযুক্তফ্রন্টপেয়েছিল ১৬টি বড় দল হলেও আওয়ামী লীগের ভাগে এসেছিল মাত্র ১২টি আসন পরবর্তীকালে উপনির্বাচনের মাধ্যমে একটি আসন পাওয়ায় দলটির সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৩
 নৈরাশ্যজনক ঘটনাপ্রবাহ সত্ত্বেও এদেশের ইতিহাসে এপ্রিল স্মরণীয় হয়ে আছে একটি প্রধান কারণে সেদিনই প্রথমবারের মতো জনগণের ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছিল
নির্বাচন ১৯৫৪  ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ এবং পাঁচটি দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দলগুলো ছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, . কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি, মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম, হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল এবং খিলাফতে রববানী পার্টি

মার্চ মাসের থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক পরিষদের ৩০৪টি আসনের জন্য ১২৮৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৫টি আসনে প্রার্থীগণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ২২৮টি আসনের জন্য প্রার্থী ছিলেন ৯৮৬ জন, সাধারণ হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত ৩০টি আসনের জন্য ১০১ জন প্রার্থী এবং তফসিলী সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত ৩৬টি আসনের জন্য প্রার্থী ছিলেন ১৫১ জন অমুসলিমদের আসনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাদের মধ্যে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি এবং তফসিলী ফেডারেশনের প্রার্থী ছিলেন মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ,৯৭,৪৮,৫৬৮ জন তাদের মধ্যে ৭৩,৪৪,২১৬ জন ভোটার (৩৭.১৯%) ভোট দেন অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক লোক ভোট দেওয়ার কারণ ছিল গ্রামাঞ্চলের অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা এবং মুসলিম মহিলাদের ঘরের বাইরে যেতে অনীহা

নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ৩০৯টি আসনের মধ্যে ২২৮টি আসন লাভ করে এর মধ্যে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৯টি আসনও ছিল ১৯৩৭ সাল থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় আসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৭টি আসন যুক্তফ্রন্টের ২২৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ পায় ১৪৩টি আসন, কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮, নেজামে ইসলাম ২২, গণতন্ত্রী দল ১৩, এবং খেলাফতে রববানী পার্টি পায় ২টি আসন অমুসলিম আসনে কংগ্রেস পায় ২৫টি, তফসিলী ফেডারেশন ২৭টি এবং সংখ্যালঘুদের যুক্তফ্রন্ট পায় ১৩টি আসন

নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্তফ্রন্ট প্রচার করে ২১-দফার একটি ম্যানিফেস্টো দফাগুলির মধ্যে ছিল: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, জমিদারি প্রথা বিলোপ, পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, সমবায় পদ্ধতিতে চাষবাস, উদ্বাস্ত্তদের পুনর্বাসন, বন্যা প্রতিরোধের স্থায়ী ব্যবস্থা, কৃষির আধুনিকায়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, সকল কালাকানুন রহিতকরণ, সমন্বিত বেতন কাঠামো প্রবর্তন, দুর্নীতি দমন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, ভাষা শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা উন্নয়নের কেন্দ্রে রূপান্তর, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা এবং পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা এসব দাবি উপস্থাপন করেন . কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,  মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমান বামপন্থী দলগুলির কর্মীদের সহায়তায় ফ্রন্টের নেতাগণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েও নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে সক্ষম হন যুক্তফ্রন্ট যেসব বিষয় জনসমক্ষে তুলে ধরে সেগুলি ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য ছাত্রদের আত্মাহুতি এবং লবণ, চাল অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান মূল্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বহু নেতাকর্মীর ধরপাকড়ে জনসাধারণ মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে ওঠে
কিন্তু যুক্তফ্রন্টের বিজয় অতি শীঘ্রই অসার প্রমাণিত হয় ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামান কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের আহবান জানান তিনি এপ্রিল সরকার গঠন করেন, কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগকে এতে শরিক করেন নি এর ফলে ফ্রন্টে একটি সঙ্কট সৃষ্টি হয় এবং ফজলুল হক বাধ্য হয়ে ১৫ মে তাঁর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করে আওয়ামী লীগের আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুস সালাম খান এবং হাশিমুদ্দিনকে এর অন্তর্ভুক্ত করেন দিনই নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকলে বাঙালি অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রায় ১৫০০ শ্রমিক নিহত হয় এর জন্য কমিউনিস্ট কর্মিদের দায়ী করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় ফজলুল হক সরকারকে দায়ী করা হয় ৩০ মে তাঁর মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে সরাসরি গভর্নরের শাসন চালু করা হয় ফ্রন্টের ১৬০০ নেতা-কর্মীকে আটক করে জেলে পাঠানো হয় এর মধ্যে প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত ৩০ জন সদস্যও ছিলেন আওয়ামী লীগ অবশ্য ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট ক্ষমতায় আসে তখন মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁদের পদত্যাগ করতে হয়

3 comments:

Powered by Blogger.