বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংবাদিকতা বিকাশের ধারা সাংবাদিকতার ইতিহাস
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংবাদিকতা বিকাশের ধারা
পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে যোগাযোগের উদ্ভব শুরু হয়। তবে বিভিন্ন সময় যোগাযোগের ধরণ ছিল বিভিন্ন রকম। সে যুগে সত্যিকার সাংবাদিকতা বলে কিছু ছিল না। প্রকৃত পক্ষে সাংবাদিকতার জন্য যে ধরনের যোগাযোগ প্রক্রিয়া বা ধরন প্রয়োজন তার আবিষ্কার অনেক পরে। অনেকের মতে, সাংবাদিকতার ত্রকেবারে আদি পর্বটি শুরু হয়েছিল জুলিয়াস জিসারের আমলে অর্থাৎ ৫০ সালে।
সে সময় রোমে ত্রক ধরনের লোক কাজ করত সংবাদ লেখক হিসেবে। সে সময়ের ঘটনাবলীর ওপর ধারাবাহিক লেখার আদিনাম হচ্ছে Acta diurna.
ত্রকই ধারাবাহিকতায় পঞ্চদশ শতকে আভির্ভাব ঘটে গুটেনবার্গ মুদ্রণ যন্ত্রের মাধ্যমে গণমাধ্যম যুগের। আর ত্রই গণমাধ্যম উৎপত্তি ও বিকাশের চলার পথে এখন হাজির হয়েছে ইন্টারনেট যুগের।
কাগজে মুদ্রিত সংবাদপত্রের উৎপত্তি:
কাগজে মুদ্রিত সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় ৪০০ বছরেরও বেশী সময় আগে। ১৬০৫-১৬১০ সালের মধ্যে। পৃথিবীর প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র Neuwe
Tidingen প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি জন্ম সম্ভবত জার্মানিতে। ইংল্যান্ড ১৬২২ ত্রবং ফ্রান্স ১৬৩১ সালে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিল।
স্বাধীন আমেরিকায় প্রথম সংবাদপত্র Best on
newsletter প্রকাশিত হয় ১৮০৪ সালে। পৃথিবীর প্রথম দৈনিক প্রকাশিত হয় ভিয়েনা থেকে ১৭০৩ সালে। পত্রিকাটির নাম Winer zeitung. ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র হিকির গেজেট ১৭৮০ সালের ২১ জানুয়ারী প্রকাশিত হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকতার বিকাশ ধারা:
সাংবাদিকতা বিকাশের পথ নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ত্রগিয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দিতে শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে সংবাদপত্রেও বিপ্লব ঘটে যায়। ধীরে ধীরে বিকাশিত হতে থাকে সংবাদপত্র শিল্প ও সাংবাদিকতা। নিম্নে বিশ্বের বিভিন্ন আমলের সাংবাদিকতা বিকাশের ধারা আলোচনা করা হল-
১) ইউরোপের সাংবাদিকতা :
ইউরোপ মহাদেশের জামানিতে ১৬০৫-১৬১০ সালে প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র Neuwe
Tidinge প্রকাশিত হয়। ইংল্যান্ডে ১৬২২ ত্রবং ফ্রান্সে ১৬৩১ সালে প্রথম সাংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ত্রছাড়াও গ্রিস, ইটালি, স্পেন, পর্তুগালে ১৭-১৮ শতাব্দীর মাঝামাঝি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। তবে সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা শাসকবর্গ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ছিল।
ইউরোপে সাংবাদিকতার বিকাশ সুখকর ছিল না।
সে সময় সাংবাদিকতা স্বাধীন ছিল না। ইউরোপের দেশগুলোতে শাসকেরা নিজেদের শাসন ও আসন পাকাপোক্ত করতে জারি করে নানা কালাকানুন। ত্রগুলো হল- ন্সেসরশীপ আইন, দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ইত্যাদি। ত্রসময় প্রেস কি প্রকাশ করবে আর কি প্রকাশ করবে না তা শাসক কর্তৃক নির্ধারিত হত।
ইউরোপে সাংবাদিকতা পেশাটি স্বাধীন হতে অনেক সময় লেগেছে। ১৭৬৬ সালে সুইডেন প্রথম সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চত করে আইন পাশ করে। ত্রর ধারাবাহিকতায় ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন- ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, পর্তুগাল, নরওয়েতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চত করা হয়। বর্তমানে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে নরওয়েতে সংবাদপত্র পাঠক সংখ্যা বেশী।
২) ল্যাটিন আমেরিকার সাংবাদিকতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর সেনাশাসিত স্বৈরশাসক ছিল। ত্রজন্য ল্যাটিন আমেরিকার সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্থ হয়। তবে ১৯৮০ সালের পর দেশগুলোর গণমাধ্যমে বাজার উন্মুক্ত হয়। গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রন জনগনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে সাংবাদিক স্বাধীন পেশায় রূপ লাভ করে। ত্র অঞ্চলের সাংবাদিকতার
বৈশিষ্ট্য-
• অধিকাংশ সংবাদপত্রই স্পেনিশ ভাষায় প্রচলিত
• পত্রিকাগুলোর আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন
• স্বৈর শাসকদের বিরুদ্ধে মিডিয়াগুলোর সমর্থন ছিল
৩) এশিয়ার সাংবাদিকতা :
ভারতের প্রথম সংবাদপত্র Calcuta
General Advertiser ত্রটি হিকির গেজেট নামেও পরিচিত। ত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৮০ সালে। ভারতের প্রথম হিন্দি সংবাদপত্র Samachar Shudra Vershan. ত্রটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৪ সালে। সাংবাদিকতার বিকাশের চায়তে শাসকদের দ্বারা সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রিত হত বেশি। তবে বর্তমানে ভারতীয় সাংবাদিকতা পূণমাত্রায় স্বাধীনতা ভোগ করছে।
১৯৮০ সাল থেকে চীনা সংবাদপত্রের প্রসার ঘটেছে। চীনের প্রাচীন সংবাদপত্র হল পিকিং গেজেট। যা ১৯১১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ত্রটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী পত্রিকা বলা হয়। চীনা সাংবাদিকতা কমিউনিজমকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ব্যবহার করা হত।
১৮৬৮ সাল থেকে জাপানে সংবাদপত্রের বিকাশ ঘটে। ১৯৯৬ সালে The Asali
Shimbun প্রকাশিত হয়। যার সার্কুলেশন বর্তমানে ১২.৭ মিলিয়ন।
৪) আমেরিকার সংবাদপত্র
আমেরিকার সাংবাদিকতা শুরু হয় ১৬৯০ সালে। প্রথম সংবাদপত্র Public
Occurrence প্রকাশিত হয়। ১৭৬৯ সালে আইজ্যাক ভুলিটল আমেরিকান ছাপাখানা তৈরী করে হয়। ১৯১১ সালে জোসেফ পুলিৎজার দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা স্কুল চালু করে। ১৯২০ সালে বেতার স্টেশন বাউফা সম্প্রচার শুরু করে। বিশ্বের পুজিঁবাদী ও উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলো বর্তমানে আমেরিকার সাংবাদিকতা অনুসরন করে।
৫)আফ্রিকান সাংবাদিকতা
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পিছিয়ে পড়া আফ্রিকার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। সংগত কারনেই ত্র অঞ্চলে সাংবাদিকতা বেশী দূর অগ্রসর হতে পারে। ২০০৫ সালে আফ্রিকায় ত্রকটি সংবাদ সংস্থা গঠিত হয়, যার নাম SDMA আফ্রিকায় অন্যান্য দেশের চেয়ে নাইজেরিয়ার মিডিয়াগুলো স্বাধীন ও নির্ভরযোগ্য। তবে আফ্রিকার প্রথম সংবাদপত্র হচ্ছে- সিরেয়ালিওন আডভারটাইজার। তা প্রকাশিত হয় ১৮০০ সালে।
ল্যাটিন আমেরিকা ও ইউরোপ অঞ্চলের সাংবাদিকতার মিল
1. উভয় অঞ্চলেই সংবাদপত্রের সার্কুলেশন কম
2. উদার গণতান্ত্রিক ধারা নিহিত
3. মিডিয়াগুলো কর্তৃত্ববাদী
4. মিডিয়াগুলো বৃটিশ আমেরিকান ধারা অনুসরন করে
5. এখানে মিডিয়াগুলোতে বস্তুনিষ্ঠতার চেয়ে রাজনৈতিক বিষয় গুরুত্ব পায়
6. পুজিঁপতিদের দ্বারা মিডিয়াগুলো নিয়ন্ত্রত হয়
7. মিডিয়াগুলোয় মালিকানাতে প্রাইভেট কোম্পানির আধিক্য দেখা যায়
ল্যাটিন আমেরিকা ও ইউরোপের সাংবাদিকতার পার্থক্য
1. ইউরোপে সরকারি মালিকানায় মিডিয়ার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। অন্য দিকে ল্যাটিন আমেরিকাতে ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব ঘটে।
2. ইউরোপের মিডিয়াগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নির্ভর করে। ল্যটিন আমেরিকাতে ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভর করে।
3. ইউরোপের মিডিয়াতে বৈদেশিক ইস্যু গুরুত্ব পায়। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার পত্রিকা গুলোতে বৈদেশিক ইস্যু তেমন গুরুত্ব পায় না।
4. ইউরোপে সরকারি নিয়ন্ত্রন বেশী। আমেরিকাতে কম।
আমেরিকা ও ইউরোপের সাংবাদিকতার মিল ও অমিল : সাংবাদিকতার ইতিহাস
1. আমেরিকাতে মিডিয়ার ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ হয়। ইউরোপে সরকারী উদ্যোগে মিডিয়ার বিকাশ ঘটে।
2. আমেরিকায় সংবাদপত্রের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা আছে। অন্যদিকে ইউরোপের সংবাদপত্রগুলা পুরোপুরি বিজ্ঞাপন নির্ভর।
3. ইউরোপের মিডিয়াগুলো বেশী মাত্রায় রাষ্টীয় বাধার সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে আমেরিকার মিডিয়া তুলনামূলকভাবে স্বাধীন।
4. আমেরিকার সংবাদপত্র বৈশিকভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হলেও ইউরোপের সংবাদপত্র বৈশিকভাবে ততটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।
5. বৈশিক ইস্যুতে আমেরিকান সংবাদপত্রের তৎপরতা বেশী লক্ষ্য করা যায়। পক্ষান্তরে ইউরোপের মিডিয়াতে কম তৎপরতা দেখা যায়।
আমেরিকা ও এশিয় অঞ্চলের সাংবাদিকতার মিল ও অমিল : সাংবাদিকতার ইতিহাস
1. আমেরিকার মিডিয়াগুলো বেসরকারি মালিকানাধীন। আমেরিকার মিডিয়াগুলো সারা বিশ্বের মিডিয়ার রাজ্য নিয়ন্ত্রন করছে। ত্রশিয়ার মিডিয়াগুলো সরকার কর্তৃক অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রনের কারনে দ্রুত বিকাশিত হতে পারেনি। তবে ধীরে ধীরে বেসরকারীকরন হচ্ছে।
2. এশিয়ার মিডিয়াগুলো শুরু থেকেই স্বাধীন ছিলনা। কিছু আমেরিকান মিডিয়াগুলো শুরু থেকেই স্বাধীন।
3. আমেরিকার অধিকাংশ পত্রিকাই স্পেনিশ ও ইংলিশ ভাষায়। আবার ত্রশিয় অঞ্চলের মিডিয়াগুলো নানান ভাষা যেমন- ইংরেজি, হিন্দি, আরবি, চীনা ভাষায় হয়ে থাকে।
সমাজতান্ত্রিক ও পুজিঁবাদী গণতান্ত্রিক দেশসমূহের গণমাধ্যম গুলোর পার্থক্য
1. রাশিয়া, উওর কোরিয়া, চীন, কিউবা প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক দেশে কেবল তাদের বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য ত্রবং সমাজতান্ত্রিক ধারনাকে লালন করে । দেশের শাসন ব্যবস্থার গুনকীর্তন করাই মিডিয়াগুলোর ধর্ম।
2. পুজিঁবাদী গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে শাসক ত্রবং শাসন ব্যবস্থার সম্পর্কে সমালোচনামূলক রিপোর্ট তৈরী করে।
3. সমাজতান্ত্রিক দেশের মিডিয়াগুলো সরকার কর্তৃক অধিক মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত। গণতান্ত্রিক দেশে কম।
4. সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে মিডিয়া বেসরকারী খাতে বিকাশিত নয়। গণতান্ত্রিক দেশে মিডিয়ার বিকাশ ঘটে বেসরকারি খাতে।
No comments