হলুদ সাংবাদিকতা কী? হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাস

হলুদ সাংবাদিকতা কী হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাস

হলুদ সাংবাদিকতা কী

আমেরিকা কর্তৃক প্রচলিত এবং বিশ্বব্যাপী বহুল ব্যবহৃত একটি টার্ম হলো ইয়োলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা। এটি ইয়েলো প্রেস নামেও পরিচিত।

হলুদ সাংবাদিকতা হলো মূলত সংবাদপত্রের কাটতি বাড়ানোর লক্ষ্যে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এখানে সংবাদের যৌক্তিকতা, সত্যতা, গুরুত্ব, নৈতিকতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা ইত্যাদি সকল বিষয়গুলোকে পেছনে ফেলে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই চাঞ্চল্যকর গল্প তৈরি করা হয়। এসকল গল্পকে মুখরোচক কাহিনী হিসেবে পাঠক বা শ্রোতার সামনে এমন ভাবে তুলে ধরা হয় যেন সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। এভাবেই সার্কুলেশন বাড়িয়ে পত্রিকা লাভবান হয়। এখানে নৈতিকতার কোন অস্তিত্ব থাকে না।

বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে হলুদ সাংবাদিকতা আরো বিস্তার লাভ করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবখানেই ছড়িয়ে পড়ছে এসকল চাঞ্চল্যকর সংবাদগুলো। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় যেহেতু সকলের কাছেই সব ধরনের প্রবেশ থাকে, ফলে মূহুর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে ধরনের সংবাদ গুলো। কোন রকম যাচাই বাছাই ছাড়াই মাধ্যম ব্যবহারকারীগণ এসব সংবাদ শেয়ার করছেন নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বন্ধুদের সাথে। ফলে অনলাইন পত্রিকা গুলো পাচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউজ।

এছাড়া বর্তমানে মোবাইল জার্নালিজম এর মাধ্যমে যে কেউই সংবাদকর্মীর ভূমিকা পালন করতে পারেন। সর্বত্র এন্ড্রয়েড ফোনের ব্যবহার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবাধ বিচরণের সুযোগ সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এটি একদিকে যেমন সকলের জন্য আনন্দের বিষয় অপরদিকে খুব বেশি চিন্তারও কারণ। কেননা, যেহেতু যেকেউ যেকোন স্থান থেকে যে কোন সংবাদ প্রচার বা প্রকাশ করতে পারে সামাজিক মাধ্যমে, ফলে সংবাদের যৌক্তিকতা, বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করার তেমন কোন সুযোগ থাকছে না। পরিণামে হলুদ সাংবাদিকতার সম্ভাবনা আরো বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

উদাহরণস্বরূপ: এবিষয়ে আমাদের দেশের কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। মানবতাবিরোধী অপরাধ যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিচার চলাকালীন সময়ে বিচারকার্যকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে ছবিযুক্ত এমন একটি নিউজ ভাইরাল হয় যা জনমনে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এটি হলুদ সাংবাদিকতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।


এছাড়া নির্বাচন চলাকালীন সময়ে আমাদের দেশে চলে হলুদ সাংবাদিকতার ভরা মৌসুম। এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে নানা ধরনের নোংরা মন মানসিকতার পরিচয় দেন। যেহেতু বর্তমান সময়ে মিডিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবসায়িক শ্রেণির প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করছে, ফলে এসব শ্রেণির চিন্তা ভাবনা গুলো নানাভাবে সংবাদ আকারে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। আর এভাবেই হলুদ সাংবাদিকতায় ভরে ওঠে আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো।

এছাড়াও চিত্রনায়ক- নায়িকাদের নিয়েও নানা ভিত্তিহীন, চাঞ্চল্যকর মুখরোচক তথ্য দেখা যায় সংবাদমাধ্যমগুলোতে। শ্রেফ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভিউজ বাড়ানোই থাকে এসব নিউজের মূল লক্ষ্য।

হলুদ সাংবাদিকতার উদ্ভব

হলুদ সাংবাদিকতা উদ্ভব কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। ইয়েলো জার্নালিজম এর উদ্ভব হয় ১৮৯০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রখ্যাত সাংবাদিক উইলিয়াম র্্যান্ডল্ফ হার্সট এবং জোসেফ পুলিৎজারকে ঘিরে। নিউইয়র্ক শহরের দুটি পত্রিকা দি ওয়ার্ল্ড এবং দি জার্নাল এর মধ্যে এক ধরনের অসুস্থ এবং ভয়ংকর প্রতিযোগিতার জের ধরে এটি শুরু হয়।

১৮৮৩ সালের দিকে জোসেফ পুলিৎজার নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড পত্রিকাটি ক্রয় করে নেন। সে সময় রাজনৈতিক প্রতিবেদন, দুর্নীতি সামাজিক অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রঙিন সংবেদনশীল প্রতিবেদন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সার্কুলেশন সমৃদ্ধ পত্রিকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড।

১৮৯৫ সালের দিকে বহুল জনপ্রিয় সান ফ্রান্সিসকো এক্সামাইনর পত্রিকার সম্পাদক উইলিয়াম র্্যান্ডল্ফ হার্স্ট নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড এর সাথে টেক্কা দেবার মনস্থির করেন। এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে দেন। সংবেদনশীল সংবাদ প্রতিবেদন, ক্রুশেড এবং রোববারে সাপ্তাহিক ফিচার সানডে ওয়ার্ল্ড এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতা শুরু করেন তিনি।

প্রথমে তিনি তাঁর সান ফ্রান্সিসকো এক্সাইমানার থেকে কিছু সাংবাদিক এবং নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড এর কিছু সাংবাদিককে নিজের নতুন পত্রিকার জন্য নিয়োগ দেন। এদের মধ্যে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড এর বিখ্যাত সাংবাদিক রিচার্ড এবং বিখ্যাত কার্টুন ইয়েলো কিড এর কার্টুনিস্ট কে নিয়োগ করেন সানডে ওয়ার্ল্ড এর জন্য।

সেসময় নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড এর বিখ্যাত কার্টুনচিত্র ছিল ইয়েলো কিড। ফলে ইয়েলো কিড এর কার্টুনিস্ট যখন নিউইয়র্ক জার্নালে কাজ শুরু করেন তখন একই ধরনের কার্টুন তিনি নিউইয়র্ক জার্নালের জন্যেও আঁকেন। ইয়েলো কিড নামক এই কার্টুন এর সূত্র ধরেই এর নামকরণ করা হয় ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা হিসেবে।

দুই পত্রিকার মধ্যে এভাবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ, চাঞ্চল্যকর দৃষ্টি আকর্ষণকারী কার্টুনচিত্র পাঠকের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে একইসাথে হু হু করে বাড়তে থাকে দুটি পত্রিকারই সার্কুলেশন। কিন্তু, এর মাধ্যমে আমেরিকার সাংবাদিকতার চিত্র বদলে যায়।

বলা হয়ে থাকে যে, বিশ শতকের শুরুর দিকে হলুদ সাংবাদিকতার অবসান ঘটে। কিন্তু, রঙচঙে পাতা, সংবেদনশীল সংবাদ প্রতিবেদন থেকে শুরু করে অনেক বৈশিষ্ট্যই এখনো বর্তমান আছে। বরং, বলা যায় নতুন রূপে আরো দৃঢ়ভাবে হলুদ সাংবাদিকতা বা ইয়েলো জার্নালিজম নিজের জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বের সর্বত্র এবং সব ধরনের সংবাদ মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

No comments

Powered by Blogger.