পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও।

পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও(অনার্স পরিক্ষা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-২০১৯)
Give an account of the economic disparity between east and West Pakistan.
পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য
একাত্তরপূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশ, পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কেবল যে ১৩০০ মাইলের
ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল, তা নয় এই দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান এবং বৈষম্যও ছিল প্রকট ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৪ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্যের ভারে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে যায় বাংলাদেশের অভ্যুদয় এর পেছনে পাকিস্তানের এই দুই অংশের মধ্যেকার পর্বতসম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাট প্রভাব রেখেছে পাকিস্তান আমলের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ডাটার মাধ্যমে এই বৈষম্যের প্রকৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করছি
প্রথমেই আসা যাক GDP ( Gross Domestic Product ) এর প্রশ্নে দেশবিভাগের পরপর পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল . % এবং পশ্চিম পাকিস্তানের .% ১৯৫৪-৫৫ থেকে ১৯৫৯-৬০ সালে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল পূর্ব পাকিস্তানে .% এবং পশ্চিম পাকিস্তানে .% উৎপাদনের উপাদানের সুষম বণ্টন না হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ে এবং জিডিপি কমতে থাকে যার ফলে দেখা যায় ১৯৪৯-৫০ অর্থবছরে পশ্চিম পাকিস্তানের জিডিপি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে % বেশি, যা ১৯৫৪-৫৫ অর্থবছরে হয়ে যায় ১৯.৬৬% বেশি

লন্ডন থেকে প্রকাশিত ফাইনান্সিয়াল টাইমস কাগজে ১৯৭১ সালে চার্লস স্মিথ লিখেছিলেন, "পূর্ব বঙ্গ যদি পৃথিবীর আটটি দরিদ্রতম দেশের মধ্যে একটি হয়, তবে তার কিছুটা কারণ এই যে, এটি পাকিস্তানের একটি অংশ ...১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হবার সময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পূর্ব বঙ্গ নতুন দেশের পশ্চিম প্রান্তের থেকে ভালো অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কথা কথা ভাবলে, পূর্ব পাকিস্তানের জল সিক্ত গ্রামাঞ্চল শুষ্ক পশ্চিমের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি সম্ভাবনাময় ছিল...পূর্ব পাকিস্তানের যা ছিল না, এবং এখনও পর্যন্ত নেই, তা হল রাজনৈতিক ক্ষমতা আর, যে ভাবে এই ক্ষমতার ব্যবহার করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তার ফলেই  সর্বনাশের শুরু " – এই কথার সপক্ষে আমরা দেখি যে ১৯৫৭ সালের মাথাপিছু আয় সূচক অনুযায়ী পৃথিবীর ৭০ টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ৫৭ তম; মাথাপিছু আয় ৫১ মার্কিন ডলার সে সময় পূর্ব পাকিস্তান যদি স্বতন্ত্র একটি দেশ হত, তাহলে তার অবস্থান হত ৫৯ তম এবং মাথাপিছু আয় হত ৪৬ মার্কিন ডলার


                                       টেবিল - পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়

                                 ( ১৯৫৯-৬০ এর মূল্যতালিকা অনুসারে, পাকিস্তানি রুপিতে)

গড় বার্ষিক বাজেট
মোট রাজস্ব
,০০০ মিলিওন রুপি
পশ্চিম পাকিস্তান
পূর্ব পাকিস্তান
সামরিক খাতে খরচ
মোট ৬০%
৫০%
১০&
বেসামরিক খাতে খরচ
মোট ৪০%
২৫%
১৫%
যখন পূর্ব পাকিস্তান মোট রাজস্বের ৬০আয় করে কিন্তু বিনিময়ে মাত্র ২৫খরচ পায় তখন পশ্চিম পাকিস্তান মোট রাজস্বের ৪০আয় করে ৭৫খরচ করে
                  বৈদেশিক বানিজ্য  আমদানি-রপ্তানি আয়
১০ বছর সময়ে
১৯৫৮-১৯৬৮
পশ্চিম পাকিস্তান
রপ্তানি
আমদানি
৮২০ মিলিওন ইউরো
২৩১৫ মিলিওন ইউরো
৪১%
৭০%
রপ্তানি
আমদানি
১১৫৩ মিলিওন ইউরো
১০০০ মিলিওন ইউরো
৫৯%
৩০%
পূর্ব পাকিস্তান
বৈদেশিক বানিজ্যের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান রপ্তানি করে মোট বানিজ্যের ৫৯কিন্তু আমদানি করে মাত্র ৩০যেখানে রয়েছে খাদ্য  নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং অতিক্ষুদ্র পরিমানে উন্নয়ন সামগ্রী। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান মোট বৈদেশিক আয়ের ৪১আয় করে কিন্তু ৭০রপ্তানি করে। এর উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করা হয় বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজে যেটা হয়ে থাকে পুরোপুরি পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলে
[ সূত্র: পাকিস্তানের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, পৃষ্ঠা ১১ এবং পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশন প্রকাশিত চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৭০-৭৫) জন্য গঠিত এডভাইসরি প্যানেলের রিপোর্ট, পৃষ্ঠা ১৩২]
উন্নয়ন বাজেটের দিক দিয়েও পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চিত ছিল পাকিস্তানের প্রায় ৬০% মানুষ পূর্ব    পাকিস্তানি হলেও অংশে ১৯৫০-৫১ থেকে ১৯৫৪-৫৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ ছিল মাত্র ২০% যা পরবর্তীতে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় ( ১৯৬৫-৭০ সালে) যদিও বাড়ে, কিন্তু তা কেবল মোট বাজেটের ৩৬% এসে দাঁড়ায় পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়নে সহায়তার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেখানে সম্পদ নিয়ে যাওয়া হয় তিনটি সুনির্দিষ্ট কৌশলে সম্পদের এই স্থানান্তর করা হয় প্রথমত, আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদের স্থানান্তর : আমদানি নিয়ন্ত্রণ থাকায় পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশি মূল্যে পণ্য কিনতে বাধ্য হত আমদানিতে এই নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এসব পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কম মূল্যে কেনা যেত দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক সাহায্যের সামান্য অংশই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ হত তৃতীয়ত, শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় সাহায্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি উদ্বৃত্ত (কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা) পশ্চিম পাকিস্তানের কারখানায় ব্যয় করা হত এছাড়াও জটিল ট্যাক্সেশন প্রণালির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে যত সম্পদ নিত ততটা ব্যয় বরাদ্দে ফিরিয়ে দিত না (Feldman 1971). এক হিসাব অনুযায়ী, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমে স্থানান্তরিত সম্পদের পরিমাণ প্রায় . বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের ( Rahman 1968). (সূত্র:’’ Educational Disparity in East and West Pakistan, 1947-71: Was East Pakistan Discriminated Against?’’ By Mohammad Niaz Asadullah)

নিচের টেবিল থেকে পূর্ব  পশ্চিম পাকিস্তানে বরাদ্দে বৈষম্য দেখা যায়:

১৯৪৭-৭০ সাল পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিল ৫৪.৭%। কিন্তু রপ্তানি আয়ে এগিয়ে থাকলেও আমদানি ব্যয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩১.১%। পূর্ব পাকিস্তানে সহজলভ্য কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানে অধিকাংশ শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়। সস্তায় কাঁচামাল সরবরাহ করে বেশি দাম দিয়ে পশ্চিমে উৎপাদিত পণ্য কিনতে হত পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদেরকে। এছাড়া যাও বা সামান্য শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছিল পূর্বে, সেসবের মালিকানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। পাকিস্তানের শিল্প মূলত ৪৩ টি পরিবারের হাতে ছিল। যার মধ্যে ২২ টি পরিবার পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক হলেও কেবল একটি পরিবার ছিল বাঙালি। ১৯৬২ সালে ৭৩% ব্যক্তিমালিকানাধীন অর্থনীতি এই ৪৩ পরিবারের হাতে ছিল। ৭ জন পশ্চিম পাকিস্তানি ছিল মোট ব্যাংক জামানতের ৬০% এর মালিক। মোট শিল্প সম্পদের ১৮% বাঙালি ও ৪৭% পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকানায় এবং ৩৫% রাষ্ট্রায়ত্ত ছিল।  

ব্যবসা বাণিজ্য শিল্পক্ষেত্রের বাইরে চাকরিক্ষেত্রেও বঞ্চনা ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি। অধিকাংশ সরকারি দপ্তরের সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাসমূহ সেখানেই অনুষ্ঠিত হত। হাজার-দেড় হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রদের পক্ষে চাকরির পরীক্ষা দিতে যাওয়া প্রায়ই সম্ভব হত না।

পাকিস্তানের সামরিক বিভাগে নিয়োগে কোটা প্রথা ছিল। মোট পদের ৬০% পাঞ্জাবি, ৩৫% পাঠান এবং বাকি ৫% পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অংশের অধিবাসী ও পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য বরাদ্দ ছিল। বাঙালিদের দাবির মুখে সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও তা ছিল নগণ্য। ১৯৫৭ সালে মেজরের উপরের পদে ৮৯৭ জন কর্মতার মাঝে বাঙালি ছিলেন ১৩ জন। কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার, মেজর জেনারেল ও জেনারেল পদে কোন বাঙালি ছিলেন না।

বেসামরিক প্রশাসনেও পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি বৈষম্য ছিল। ১৯৫৫ সালে ১৯ জন সচিবের মধ্যে একজন বাঙালিও ছিলেন না। ৪১ জন যুগ্মসচিবের মাঝে ৩ জন ছিলেন বাঙালি। ১৩৩ জন উপসচিবের মধ্যে ১০ জন এবং ৫৪৮ জন বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তার মধ্যে ৩৮ জন ছিলেন বাঙালি।


বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব বৈষম্যের প্রতিফলন দেখা যায় পূর্ব ও পশ্চিমের জীবনযাত্রার মানে। প্রধান দুটি খাদ্যশস্য, ধান ও গমের মূল্যে দুই অংশে ছিল বিশাল ফারাক। পশ্চিম পাকিস্তানে যখন চালের দাম মণ প্রতি ১৮ রুপি, পূর্বে তখন প্রায় তিনগুণ, ৫০ রুপি। পশ্চিম পাকিস্তানে গমের মণ যখন ১০ রুপি, পূর্ব পাকিস্তানে ৩৫ রুপি। একই দেশের দুই অংশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামে এত পার্থক্য স্বাভাবিক ছিল না। মাথাপিছু আয় কম হলেও পূর্ব পাকিস্তানে জীবনযাত্রার ব্যয় ছিল বেশি। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানিদের জীবনযাত্রার মান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে নিচু।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে স্বর্ণ এবং টাকাপয়সা নিতে কোন বাধা ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্বে আনতে বাধা ছিল। এসব কারণে একই দেশের দুই প্রান্তে স্বর্ণের দামে বিরাট পার্থক্য ছিল।

১৯৭০ সালের একটি নির্বাচনী পোস্টার থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই চিত্র পাওয়া যায় : 

অর্থনীতিতে চলতে থাকা বৈষম্যের ফলে পশ্চিমের তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান। পর পর তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বঞ্চিত হওয়ার পরে ১৯৭০ সালে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে সোচ্চার হন। দুই অংশ থেকে ৬ জন করে মোট ১২ জন অর্থনীতিবিদ নিয়ে গঠিত এডভাইসরি কমিটির মধ্যে দ্বিমত দেখা  দেয়। তাঁরা পৃথকভাবে দুটি রিপোর্ট তৈরি করেন ও তা সরকারের কাছে পেশ করেন। মূল প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন বাঙালি অর্থনীতিবিদ মাজহারুল হক; তাঁর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদেরা যে রিপোর্ট তৈরি করেন সে রিপোর্টের শুরু হয় এভাবে, ‘’ The future of the nation, indeed its very survival, hinges on whether the benefits and burdens of economic development can be shared equitably by the people of all the regions,’’

প্যানেল দ্বিধাবিভক্ত হওয়া নিয়ে তাঁরা আক্ষেপ প্রকাশ করেন। এবং তাঁদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ‘’ We have proposed merely that the Fourth Plan allocation between East and West Pakistan be made in proportion to population,” সাথে এও বলেন যে এটুকু পদক্ষেপই যথেষ্ট না এবং পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আরও বেশি প্রণোদনা প্রয়োজন হবে। ‘’Our colleagues from West Pakistan, however, could not be persuaded to agree even to our moderate proposal.’’

এভাবেই ক্রমশ সকল পর্যায়ে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বরুপ অনুধাবন করে ধীরে ধীরে এটাই প্রকট হতে থাকে যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হয়ে ওঠার বীজ পোঁতা হয় অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভূমিতে।

No comments

Powered by Blogger.