বাংলা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে টিকা লিখ। (অনার্স পরিক্ষা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-২০১৯)


 Write a Short note about the origin of the name of Bangla.
 বাংলা মাত্র তিন বর্ণের একটি শব্দ। কিন্তু এটি একটি ইতিহাস। প্রাচীনকালে সমগ্র বাংলাদেশের বিশিষ্ট কোন নাম ছিল না। এর এক একটি অংশ এক এক ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। বাংলা নামের উৎপত্তিতে রয়েছে অনেক চড়াই উতরাই। বৈদিক যুগের আর্যগণ বাংলার সাথে পরিচিত ছিল না এবং তাদের গ্রন্থ ‘ঋক সংহিতায়' এরূপ কোন নামের উল্লেখ
নেই। সর্বপ্রথম বঙ্গ নামের উল্লেখ দেখা যায় ঐতরেয় আরণ্যকে। এতে বঙ্গকলিঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী বলে এর অধিবাসীদের সম্পর্কে নানা প্রকার ‘অশ্রদ্ধাসূচক' মন্তব্য রয়েছে। বৈদিক যুগের শেষ ভাগে রচিত কতগুলো গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, বাংলাদেশে-মগধ, চের ও বঙ্গ এই তিনটি অঞ্চল ছিল। রামায়ণ ও মহাভারতে একাধিকবার বঙ্গ নামের উল্লেখ আছে। এই দুই মহাকাব্যে পুন্ড্র (উত্তরবঙ্গ) বঙ্গ (দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ) সূক্ষ্ম (পশ্চিমবঙ্গ) তাম্রলিপিসহ প্রভৃতিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। জৈনসূত্র আচারঙ্গ গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, পুন্ড্র বা রাঢ় দেশ তখন সূক্ষ্মভূমি ও বজ্রভূমি নামে দুইভাগে বিভক্ত ছিল। প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য ও বঙ্গ ও সূক্ষ্ম এই দুটি অঞ্চলের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। অঙ্গুত্তবণি বৌদ্ধজাতক ও দিব্যাবদনের বঙ্গ, রাঢ় ও পুন্ড্রবর্ধনের উল্লেখ আছে। মিলিন্দ পঞ্চহে গ্রন্থে বঙ্গকে একটি সামুদ্রিক বন্দর বলা হয়েছে। গ্রীক লেখকদের রচনায় বঙ্গ নামের কোন শব্দের উল্লেখ নেই। তেমনি মৌর্য যুগ ও অন্যান্য রাজবংশের শাসনামলে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে বাংলার উল্লেখ পাওয়া যায় না। গুপ্তযুগের শিলালিপি ও কালিদাসের রচনায় বঙ্গের উল্লেখ থাকলেও এর সীমারেখা সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয়নি। বর্তমানে যে ভূখন্ড নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত; পূর্বে এর অধিকাংশ অংশ ‘বঙ্গ' নামে পরিচিত ছিল। এটি অতি প্রাচীনকাল হতে বিদ্যমান ছিল। তখন ইহা কতকগুলি খন্ডরাজ্যে বিভক্ত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে তখন রাঢ় ও তাম্রলিপ্ত; বাংলাদেশে তখন বঙ্গ সমতট হরিকেল এবং উত্তরবঙ্গে পুন্ড্র ও বরেন্দ্র এই কয়টি পৃথক রাজ্য ছিল। প্রাচীন বাংলার জনপদের সীমানা নির্ধারণ সম্ভব নয়। কারণ, রাজশক্তির হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইহার সীমানাও পরিবর্তিত হয়েছে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর শশাঙ্ক গৌড়ে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। বর্তমান উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে ইহা গঠিত ছিল। বঙ্গেশ্বর বলে দাবি করেননি বরং গৌড়েশ্বর বলেই পরিচিত ছিলেন। তখন তিনি কখনও বঙ্গ ও হরিকেল তাঁর শাসনাধীন বলে মনে হয় না। অবশ্য সে সময় হতে গৌড় বলতে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশকে বুঝানো হতো। পাল ও সেন যুগে যুগে গৌড়ের রাজ্যসীমা অনেকদূর বিস্তার লাভ করেছিলো। তাই কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কহলন তাঁর ‘রজতবঙ্গিনী' গ্রন্থে গৌড়ের উল্লেখ করেছিলেন। শাসনতান্ত্রিক দিক হতে বাংলাদেশ তখন পুন্ড্রবর্ধনভুক্তি, বর্ধমানভুক্তি, কঙ্গগ্রামভুক্তি প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বখতিয়ার খল্জী তখন লক্ষ্মণ সেনের নিকট হতে নদীয়া ও লাখনৌতি দখল করেন। তখন বাংলাদেশ রাঢ়, বাগড়ী, বঙ্গ, বরেন্দ্র ও মিথিলা এ পাঁচটি খন্ডে ভাগ ছিল। মুসলমানগণ গৌড় দখল করলেও রাঢ় ও বরেন্দ্র ব্যতীত বাকি অঞ্চলে বহুদিন ধরে হিন্দুশাসন বিদ্যমান ছিল। বখতিয়ার খল্জী লাখনৌতি দখলের পর হতে দিল্লীর সুলতানদের নিকট এই অঞ্চল লাখনৌতি বা গৌড় বলে পরিচিত ছিল। এখানে ঘন ঘন গোলযোগ দেখা দিত বলে তাঁরা একে ‘বুলঘকপুর' বা বিদ্রোহী নগরী বলে অভিহিত করতেন। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার বিদ্রোহী শাসকদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ করে দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক একে লক্ষ্মণাবতী, সাতগাঁও ও সোনাগাঁও-এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করেন এবং প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু এ নাম ও বিভাগ স্থায়ী হয়নি। স্বাধীন সুলতানদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে আবার গৌড়কে কেন্দ্র করে বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেছিল। সমসাময়িককালের দিল্লী সাম্রাজ্যের তুলনায় গৌড় অনেক বৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল। বাংলা নামটি মুঘল যুগেই সর্বপ্রথম দেশবাচক নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সম্রাট আকবরের রাজমহল দখলের পর হতে ইহা একটি সুবার মর্যাদা লাভ করে এবং মুঘল দলিলপত্রে এর নামকরণ হয় ‘সুবে বাঙালা'। মুঘল ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থে এই নামের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি অদ্ভুত কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। আবুল ফজলের মতে ‘বাংলাদেশের অতি প্রাচীন নাম হইল বাং বা বাঙ্গ। এই বঙ্গে পুবাকালের শাসকেরা স্থানে স্থানে টিপি বা জাঙ্গাল নির্মাণ করিত। এই টিপি দশ হাত উঁচু ও বিশ হাত প্রশস্ত হইত। সম্ভবতঃ বহিরাক্রমণ হইতে দেশকে সুরক্ষিত করিবার জন্য বিশেষ বিশেষ স্থানে মৃত্তিকা দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ের ন্যায় দুর্গ-প্রাচীর প্রস্তুত করা হইত। ‘আল' বা ‘আলি' শব্দের অর্থ বাঁধ। এই সমস্ত বাঁধের পার্শ্বস্থ খাল বা নালায় মানুষ যাতায়াতের জন্য ‘সাঁকো' নির্মিত হইত। যেইযেতু ‘বাঙ্গ' ও আল এই কথা দুইটির সংমিশ্রণে (বঙ্গ + আল + বাঙ্গাল) ক্রমে ক্রমে ‘বাঙ্গালা' নামের উৎপত্তি হইয়াছে'। তবে আধুনিককালের ঐতিহাসিকগণ আবুল ফজলের উক্তির সাথে একমত নন। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ‘খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী সম্ভবত আরও প্রাচীনকাল হইতেই ‘বঙ্গ' বা ‘বাঙ্গাল' দুইটি পৃথক দেশ ছিল এবং অনেক প্রাচীন লিপি ও গ্রন্থে এই দুইটি দেশের একত্র উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং বঙ্গ দেশের নাম হইতে আল যোগে অথবা অন্য কোন কারণে বঙ্গাল অথবা বাংলা নামের উদ্ভব হইয়াছে ইহা স্বীকার করা যায় না। বঙ্গাল দেশের নাম হইতেই কালক্রমে সমগ্র দেশের বাংলা নামকরণ করা হইয়াছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।' যাই হোক না কেন মুঘল আমল হতে বাঙ্গালা নামটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নওয়াবী আমলে এটি ছিল দেশবাচক নাম। ইংরেজরা এ দেশকে বেঙ্গল ও বেঙ্গলা নামে অভিহিত করে। তারপর হতে ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যদেশীয় বণিকগণ কাগজপত্রে এই নামটিই ব্যবহার করতো। আধুনিককালের সাধু বাংলায় লেখা হতো বাঙ্গালা। এরপর হতে বাঙলা, বঙ্গদেশ বা বাঙলাদেশ (বাংলাদেশ) প্রভৃতি নাম ব্যবহৃত হতে থাকে। মানিক রাজার গানে ‘ভাটী' ও ‘বাঙ্গাল' উভয় শব্দই ব্যবহৃত হতো। কবি কঙ্কন বাঙ্গাল শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। কালক্রমে তা বাংলা থেকে বাংলাদেশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। আলী আকবর, শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, বাংলাভাষা ও সাহিত্য

No comments

Powered by Blogger.